অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ খেরসন থেকে গত কয়েক দিন ধরে জোরেশোরে বেসামরিকদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে রাশিয়া। বেলজিয়ামের সমান আয়তনের শহরটি ক্রিমিয়া উপদ্বীপের প্রবেশ পথ। ফেব্রুয়ারিতে রুশ আক্রমণ শুরুর পরই খেরসনের দখল নিয়েছিল রাশিয়া।
ডিনিপার নদী দ্বারা বিভক্ত খেরসন হলো প্রথম ইউক্রেনীয় শহর যা পুরোপুরি দখল করতে সক্ষম হয় রাশিয়া। দখলের পর এখানে কয়েক হাজার সেনা তারা মোতায়েন করেছিল।
ডিনিপার নদীর পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখান থেকে আরও উত্তর ও পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারবে রুশ সেনারা।
কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইউক্রেনের সেনারা পশ্চিম তীরে বেশ কয়েকটি গ্রাম ও শহর রুশদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করেছে। একই সময় তারা ডিনিপার নদীর সেতু, ফেরি ও পন্টুনে হামলা চালিয়েছে। অস্ত্র গুদামে চালিয়ে গুপ্ত হামলা।
তাই গত দশ দিন ধরে মস্কো এবং খেরসনে তাদের পুতুল প্রশাসন শহরের পশ্চিম অংশে বসবাসরত হাজারো বেসামরিক নাগরিকদের ক্রিমিয়া ও রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে চলে যাওয়ার আহ্বান জানায়।
বৃহস্পতিবার মস্কো মনোনীত কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, এখন পর্যন্ত স্বেচ্ছায় ৭০ হাজার বেসামরিক খেরসন ছেড়ে চলে গেছেন। তাদেরকে ‘সনদ’ দেওয়া হবে। তারা রাশিয়ার যেকোন স্থানে বসবাস করতে পারবেন।
খেরসন থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ সমাপ্তের ঘোষণা দিয়ে বৃহস্পতিবার শেষ রাতে ক্রিমিয়া মস্কো মনোনীত প্রধান সের্গেই আকসিয়োনভ বলেছেন, আমি গর্বিত যে সবাই দ্রুত ও নিরাপদে শহর ছেড়েছেন। শহরের এসব স্থানে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী গোলাবর্ষণ করেছে।
এদিকে, ক্রেমলিনপন্থি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, শহর ছেড়ে যাওয়া রুশ সেনারা ১৮ শতকের রুশ কমান্ডারের ব্রোঞ্জের মূর্তি সঙ্গে নিয়ে গেছে।
খেরসন থেকে বেসামরিকদের সরিয়ে নেওয়ার কারণ হিসেবে রুশ কর্তপক্ষ বলছে, ইউক্রেন নোভা কাখিবভকা বাঁধে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অঞ্চলটিতে বন্যার পানিতে ডুবিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিয়েভ এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দাবি করেছেন, বেসামরিকদের সরিয়ে নেওয়া এবং রুশ কমান্ডারের ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার কারণ আতঙ্কের পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য ক্রেমলিনের পরিকল্পনা। তিনি বলেন, তাদের ভালো প্রশিক্ষিত সেনারা খেরসনে মোতায়েন রয়েছে। কেউ চলে যায়নি। আমরা দেখছি এবং তাদের বিশ্বাস করি না।
দক্ষিণাঞ্চলীয় রণক্ষেত্রে কয়েক মাস ধরে অবস্থান করা এক ইউক্রেনীয় সেনা বলেছেন, রুশ সংবাদ মাধ্যমে যে ঝড় তোলা হচ্ছে আগে থেকেই হিসাব করা এবং তা সত্য হওয়ার সুযোগ কম। তার কথায়, আমরা এই ফাঁদে পা দিচ্ছি না। কারণ এটি একেবারে পরিকল্পিত এবং মিডিয়ায় আলোচনা তৈরির জন্যই সাজানো হয়েছে। যাতে করে একটি নির্দিষ্ট অনুভুতি তৈরি করা যায়।
তিনি আরও বলেছেন, খেরসনের মতো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল থেকে রুশ সেনাদের হুট করে পিছু হটার কারণ নেই। ইউক্রেনের সামরিক নেতাদের উচিত খেরসনের সম্মুখসারিতে থাকা সেনাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা। কারণ রুশ গোলাবর্ষণ থেকে তাদের সুরক্ষা করার মতো কিছু নেই।
তিনি বলেন, বিদ্যমান শ্রমশক্তি রক্ষায় আরও অনেক কিছু করার আছে।
গোয়েন্দা তথ্য ও স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, সম্প্রতি রাশিয়া খেরসনের আঞ্চলিক রাজধানীতে প্রতিরক্ষা দূর্গ এবং প্রতিরক্ষা লাইন গড়ে তুলছে। বাদ যাচ্ছে না নোভা কাখভকাও। খেরসনের পাশের এই শহরে একটি বাঁধ রয়েছে ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে।
ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের সাবেক উপ-প্রধান ইহোর রোমানেঙ্কো বলেছেন, ডিনিপার নদীর ডান পাশের অংশ থেকে বেসামরিকদের সরিয়ে নেওয়া রাশিয়ার প্রস্তুতি ও প্রপাগান্ডা কৌশল। বাস্তবে তারা নিজেদের অবস্থান সুসংহত করছে আরও সেনা মোতায়েন করে। তারা সম্ভাব্য পাল্টা হামলা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ফেব্রুয়ারিতে আক্রমণের শুরুর দিকে মস্কো প্রত্যাশা করেছিল তাদের আক্রমণ জেলেনস্কি সরকারকে উৎখাত করবে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের ভারি প্রতিরোধের মুখে ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চল ও কিয়েভ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে রাশিয়া।
আক্রমণের নতুন লক্ষ্য হিসেবে মস্কো পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের কৃষ্ণ সাগরীয় উপকূল দখল করে প্রতিবেশী মলদোভার মস্কোপন্থী অঞ্চল ট্রান্সনিস্ট্রিয়াতে যাওয়ার স্থলপথ গড়ে তোলা নির্ধালণ করে। ওই অঞ্চলে কয়েক বছর ধরে রুশ ‘শান্তিরক্ষীরা’ মোতায়েন রয়েছে।
পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভের বেশিরভাগ অঞ্চল ইউক্রেন পুনরুদ্ধার করায় মস্কোর এই লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি। লুহানস্ক ও ডনেস্কতেও রুশ সেনারা ব্যর্থতার মুখে পড়েছে। এরপর ইউক্রেনীয় সেনারা খেরসন পুনরুদ্ধারে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।
বিধ্বস্ত ভবনের সামনে দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছেন খেরসনের এক বাসিন্দা। ছবি: আনাদোলু এজেন্সি
রোমানেঙ্কো বলেছেন, সম্প্রতি ভারী বৃষ্টি ও কাদাযুক্ত সড়কের কারণে খেরসন অভিমুখে ইউক্রেনের অগ্রগতি মন্থর হয়ে পড়েছে। তবে ইউক্রেনীয় সেনাদের কয়েকটি ছোট ছোট দল নিয়মিত রুশ কমান্ড সেন্টার, গুদাম ও রসদ সরবরাহের রুট ধ্বংস করছে এবং শ্রমশক্তি পাঠানো বিঘ্নিত করছে। নির্ণায়ক অগ্রগতি এখনও নিশ্চিত হয়নি।
তিনি বলেন, শত্রুদের দুর্বল অবস্থান আমাদের শনাক্ত করতে হবে, নিজেদের রিজার্ভ সেনাদের সংগঠিত করতে হবে, আমাদের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে হবে এবং শেষে আরও হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মস্কোপন্থি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, ৩ লাখ সেনা সংগ্রহ ও ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট ও ড্রোন দিয়ে ধ্বংস করার ফলে খেরসনের দিকে অগ্রসর হওয়া ছাড়া কিয়েভের সামনে কোনও বিকল্প নেই।
বিচ্ছিন্নতাবাদী ডনেস্ক অঞ্চলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইগোর স্ট্রেলকভ রণক্ষেত্রে থেকে ফিরে রবিবার লিখেছেন, ইউক্রেনের সেনারা অগ্রসর হতে উন্মুখ। কিন্তু তাদের পেছনের সারি এখনও সক্রিয়।
আরেক বিশ্লেষক বলেছেন, ইউক্রেনের অগ্রসরতা থমকে যাওয়ার অর্থ হলো তারা সেনা ঘাটতিতে পড়েছে। তারা সতর্কতার সঙ্গে ছোট ছোট দলকে আগেই খেরসনে পাঠাচ্ছে।
জার্মানির ব্রেমেন ইউনিভার্সিটির রুশ গবেষক নিকোলায় মিত্রোখিন বলেন, রুশ প্রতিরক্ষার ছোট আকারের ইউনিট শনাক্ত করার পরই কেবল তারা অগ্রসর হতে পারছে। প্রতিদিন ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে বলে রুশ সংবাদমাধ্যমের খবরে দাবি করা হচ্ছে। তবে তারা প্রতিনিয়ত রুশ প্রতিরক্ষায় নতুন ফাঁক-ফোকর খুঁজতে তৎপর।
তিনি আরও বলেন, এমন ফাঁক-ফোকর কার্যকর কামানের গোলাবর্ষণ বা ড্রোন অভিযানের পর সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে তাদের আরও অগ্রগতি অর্জনের সুযোগ রয়েছে।
অবশ্য থেমে নেই রাশিয়াও। নতুন নিয়োগকৃত সেনাদের দ্বারা দুর্বলতা কাটানোর চেষ্টা করছে তারা। যদিও নতুন সেনাদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই।
মিত্রোখিন বলেন, এই কারণে ইউক্রেন আশা করছে সম্মুখভাগ, সদর দফতর ও শত্রু সেনাদের ওপর কামান বা ড্রোন দিয়ে ছোট আকারের বোমা ফেললেই রুশ সেনারা ভয় পাবে এবং তাদের কৌশল কার্যকর হবে। সূত্র: আল জাজিরা
Leave a Reply